জলবায়ু পরিবর্তন আর এল নিনো আনছে বড় ঝুঁকি


প্রকাশের সময় : আগস্ট ১০, ২০২৩, ৪:৩৭ অপরাহ্ণ / ১৮১
জলবায়ু পরিবর্তন আর এল নিনো আনছে বড় ঝুঁকি

ত দিন জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মানে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিবেচনা করা হতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বাস্থ্যগত সমস্যায় রূপ নিয়েছে। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই অঞ্চলে রোগবালাই ও স্বাস্থ্য  সমস্যাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। গত কয়েক মাসে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনোর সমস্যা যুক্ত হওয়ায় দুর্যোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে গেছে।

দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (আইএফআরসি) থেকে ওই ঝুঁকি বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। এল নিনো ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চল মোট আটটি  স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি।

কোমরসমান পানি পেরিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন মানুষজন। জজকোর্ট এলাকা, বান্দরবান।ফাইল ছবি

গতকাল বুধবার সংস্থাটি থেকে বাংলাদেশের ঢাকা, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর  ও চীনের বেইজিং থেকে একযোগে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ডেঙ্গু ও ঘূর্ণিঝড়ের সমস্যায় পড়েছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও ডেঙ্গু সমস্যা তীব্র হয়েছে। মঙ্গোলিয়ায় একই সঙ্গে বন্যা ও শৈত্যপ্রবাহ এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বন্যার আঘাত দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।  

আইএফআইসি বাংলাদেশের প্রধান সময় কারনে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সঙ্গে ডেঙ্গু মোকাবিলায় গভীরভাবে কাজ করছি। এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালের অধিবাসীদের সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে দেখছি। ওই ৩ শহরের ৮৫টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুপ্রবণ বা হটস্পট এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছি। জীবনরক্ষার জন্য আমরা সব কটি এলাকায় ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছি বলে তিনি উল্লেখ করেন।’

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত এসব সমস্যা আরও তীব্রতর হতে পারে। এতে ওই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা আরও তীব্রতর হতে পারে। মূলত প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় এল নিনো নামে আবহাওয়ার এক বিশেষ অবস্থা তৈরি হওয়ায় ওই সমস্যা বাড়তে পারে। এল নিনো তৈরি হলে ওই সাগরের মাঝ বরাবর একটি উষ্ণ স্রোত তৈরি হয়।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা থেকে গত চার জুন প্রকাশ করা এল নিনোবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের পর এ বছর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এল নিনো তৈরি হয়েছে। এতে দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হবে। আর অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য আমেরিকায় খরা হতে পারে। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া মূলত খরা পরিস্থিতি থাকলেও সেখানে হঠাৎ তীব্র বৃষ্টি বেড়ে পাহাড়ধস ও শহরে জলাবদ্ধতার সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বে সবচেয়ে উষ্ণতম বছরগুলো রেকর্ড হয়েছে এল নিনো চলাকালে

বিশ্বে সবচেয়ে উষ্ণতম বছরগুলো রেকর্ড হয়েছে এল নিনো চলাকালেছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এল নিনোর প্রভাব হয়েছে গত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টি কম হয়েছে। তাপপ্রবাহ সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে ওই সময়ে। কিন্তু আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে আবার হঠাৎ করে বৃষ্টি বেড়ে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে যেকোনো আবহাওয়া পরিস্থিতি চরম আচরণ করছে। অর্থাৎ গরমের সময় তীব্র তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টির সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি হবে। হচ্ছেও তা–ই।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসেবে, গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। জুলাই মাসে ভরা বর্ষার সময়েও স্বাভাবিকের চেয়ে ৫১ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে আড়াই শতাংশ বেশি ছিল। এ ধরনের উত্তপ্ত আবহাওয়ার পর থেমে থেমে বৃষ্টি হলে তা মশা ও ডেঙ্গু বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকৃতিতে আমরা এল নিনোর প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। ফলে হঠাৎ করে প্রচুর বৃষ্টি হলেও বছরের বাকি সময়জুড়ে গরমের তীব্রতা বেশি থাকতে পারে। এই বছর তো বটেই, এল নিনোর প্রভাবে আগামী বছরও এল নিনোর কারণে একই ধরনের আবহাওয়া থাকতে পারে।’

রেডক্রসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, চলতি বছর এরই মধ্যে বাংলাদেশে ৩০ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। এর মধ্যে ডেঙ্গুর বেশ কয়েকটি ধরন বাংলাদেশে চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো স্থানীয় অধিবাসীদের নানাভাবে আক্রান্ত করছে। বেশির ভাগ আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন। কিন্তু এতে তাদের দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ডেঙ্গু মোকাবিলায় যৌথভাবে কাজ করছে বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়। এর জন্য পানি ব্যবস্থাপনাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কোথাও পানি জমে থাকলে তা মশার প্রজনন ক্ষেত্র যাতে হয়ে না উঠে, সে জন্য সবাই একযোগে কাজ করছে। এ জন্য ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে—এমন এলাকাগুলো চিহ্নিত করা এবং তা তদারক করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ব্র্যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনোর কারণে বাংলাদেশে নানা ধরনের আবহাওয়াগত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের শহরগুলোয় অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ এবং দখল–দূষণ বাড়ছে। এটা জলবায়ুর সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে গরমের তীব্রতার কারণে নগরের সচ্ছল মানুষেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। তা শহরের গরমের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে শুধু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করলে হবে না, আমাদের নিজেদের তৎপরতার কারণে যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তার ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা দূর করতে হবে।’