৪ডিসেম্বর, ফুলছড়ি থানা হানাদার মুক্ত দিবস


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২, ২০২৩, ২:৫৯ অপরাহ্ণ / ২০১
৪ডিসেম্বর, ফুলছড়ি থানা হানাদার মুক্ত দিবস

৪ ডিসেম্বর ৭১ এর এদিনে উত্তর রনাঙ্গণের প্রথম থানা হিসেবে ফুলছড়ি থানা সম্পূনর্ণরুপে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত হয়। উত্তর রণাঙ্গনের অন্যতম দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা রোস্তম আলী খন্দকারের নেতৃত্বে রোস্তাম কোম্পানির যোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে কয়েকটি স্পটে সম্মূখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। স্পটগুলি হলঃ ফুলছড়ি থানা সদর, ঘাঘট রেল ও সড়ক সেতু এবং চূড়ান্ত সম্মুখ যুদ্ধ সংগঠিত হয় সাঘাটা থানার গোবিন্দী ওয়াপদা বাঁধে দিন রাতের এ যুদ্ধে পাঁচ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তারা হলেন বগুড়ার গাবতলী থানার জাহিদুল ইসলাম বাদল, গাইবান্ধার সাঘাটা থানার আফজাল, আব্দুস সোবহান, ওসমান গণী ও কাবেজ আলী। বিপরীতে পাকিস্তানী বাহিনীর ২৭ সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি ৩০৩ রাইফেল খোঁয়া যায়। ৪ ডিসেম্বর যুদ্ধে ফুলছড়ি থানা উত্তরবঙ্গের প্রথম থানা হিসেবে হানাদার মুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ফুলছড়ি হানাদার মুক্ত হওয়ার খবরে মুক্তিযোদ্ধারা বেশি উৎসাহী হয় এবং তাদের মনোবল যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ১৬ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী মিত্রবাহিনীর পূর্বঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার নিকট আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পনের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ^ মানচিত্রে জায়গা করে নেয় । ৪ ডিসেম্বর ৭১ এ সংগঠিত যুদ্ধে সংক্ষিপ্ত কথা তুলে ধরা হল। ৩ ডিসেম্বর সকালে গলনার চরের হাইডআউটে বিশ^স্ত সূত্রে খবর আসে যে, ২ ডিসেম্বর ফুলছড়ি টি.টি.ডি.সি ও তিস্তামুখ ঘাট ক্যাম্প হতে কিছু সেনা কে প্রত্যাহার করে গাইবান্ধায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উক্ত খবরের সঠিকতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটি ফাইটিং প্লাটুন ফুলছড়ি সদরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর সকাল ০৮:০০ ঘটিকায় প্লাটুন কমান্ডার সামছুল আলম কে ফাইটিং প্লাটুন নিয়ে ফুলছড়িতে পাঠানো হয় সামছুল আলম খবরের সত্যতা যাচাই শেষে সুযোগ বুঝে ফুলছড়ি থানা রেইড করা জন্য বলা হয়। কোম্পানীর বাকি সকলে তাদের সফলতা আশা ও বিপদে পড়লে প্রস্ততি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। বেলা ১২.০০ টায় সামছুল আলম সফলভাবে তথ্য যাচাই করে সুযোগ পেয়ে ফুলছড়ি থানা রেইড করে বিনা বাঁধায় থানার মালখানা হতে ২৫ টি রাইফেল ও কয়েক বাক্র গুলি নিয়ে হাইডআউটে ফিরে আসে। কোম্পানী কমান্ডার রোস্তম ভাই ঐ সময় সাব-সেক্টর সদর মানকার চরে অব¯’ান করছিলেন। তার অনুপ¯ি’তিতে আমি কোম্পানির টু আই সি হিসেবে কোম্পানির ৬ প্লাটুন কমান্ডার ও কোম্পানির গোয়েন্দা ও সমন্বয়কারীদ্বয় কে নিয়ে এক জরুরী পরামর্শ সভায় বসি । ঐ সভায় আলমের সংগৃহীত তথ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে সভায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে , রোস্তম ভাইয়ের আসার অপেক্ষা না করে পাকিস্তানী বাহিনীর এমন দূর্বলতা কবে পাওয়া যাবে তা অনিশ্চিত , তাই ঐ দিনেই অর্থ্যাৎ ৪ ডিসেম্বরে আমরা পাকিস্তানী বাহিনীর উপর অভিযান চালাবো । সে অনুযায়ী দুপুর ২টায় সকল প্লাটুন কমান্ডারগণকে তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কে যুদ্ধ সাঝে নিয়ে সবেদ আলী মেম্বারের বাড়ীর উঠানে সমবেত হওয়ার জন্য বলা হয় । ০২:০০টার মধ্যে পুরো কোম্পানি সমবেত হয়। আমি তাদের কোন প্লাটুন কোথায় অব¯’ান নিবে ও কি দায়িত্ব পালন করবে তা জানাই। কোন প্লাটুন আক্রান্ত হলে কি সংকেত দিবে, অভিযান শেষে কোথায় সমবেত হবে তা বিস্তারিত জানাই। ০৩:০০ঘটিকায় কোম্পানীর সকল যোদ্ধাকে নিয়ে আমরা ফুলছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আলম, মহসিন, নাজিম, এনামুল এর প্লাটুন টি.টি.ডি.সি ক্যাম্পে ও ফুলছড়ি থানা এলাকায় অব¯’ান নেয়। তসলিম ও রফিকের প্লাটুন ঘাঘট রেল ও সড়ক সেতুতে অব¯’ান নেয়। ফুলছড়ি ক্যাম্পের সেনা কমান্ডার তার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন করতে যা”েছ সেই সম্ভাবনায় তারা সুরক্ষিত থাকার জন্য অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর জন্য ওয়্যারলেসে গাইবান্ধা ক্যাম্পে খবর দেয়। ফুলছড়ি ক্যাম্পে এর উপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন করলে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়, অব¯’া বেগতিক দেখে শত্রæ সেনারা সাঘাটার গোবিন্দী ওয়াপদা বাঁধের দিকে পালাতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছু পিছু ধাওয়া করে যেতে থাকে । ইতিমধ্যে রেলপথে বোনারপাড়া হতে ও সড়ক পথে গাইবান্ধা হতে ঘাঘট রেলসেতুর পশ্চিম প্রান্তে এসে পাকিস্তানি সেনারা উপ¯ি’ত হয়। তারাও ব্রীজ পাড় হয়ে গোবিন্দীর দিকে রওনা হয়। বাঁধের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমন প্রতিহত করার জন্য এ্যাম্বুস পেতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে প্রথমে পাকিস্তনী বাহিনীর বিরুদ্ধে এনামুলের প্লাটুনের সাথে যুদ্ধ হয়। একে একে সকল প্লাটুন সহ কোম্পানির সকল যোদ্ধারা যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। সেখানে তুমুল যুদ্ধ হয়। দিন রাতের এ যুদ্ধে রোস্তম কোম্পানির ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। পরদিন প্লাটুন কমান্ডার এনামুল হক ও বজলুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ গরুর গাড়ীতে খর দিয়ে ঢেকে সাঘাটার তৎকালীন সগুনা ইউনিয়নের ধনারুহা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পাঁচটি কবরে ¯’ানীয় জনগণের সহযোগিতায় ধর্মীয় নীতি অনুসরণ করে পাঁচ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ সমাহিত করা হয়। দেশ স্বাধীন হলে রোস্তম আলী খন্দকার পি.ডবিøউ.আই বোনারপাড়া ও ¯’ানীয় জনগণের সহায়তায় কবর পাঁচটি পাঁকা ও পাশের্^ একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। সগুনা ইউনিয়নে ৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধীর অব¯’ান হওয়ায় ও ¯’ানীয় জনগনের দাবীর স্বীকৃতি হিসেবে সরকার ১৯৮২ সালে গেজেট বিজ্ঞপ্তি‘র মাধ্যমে সগুনা ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন করে মুক্তিনগর ইউনিয়ন নামে নাম করণ করা হয়। প্রয়াত জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার এ্যাডঃ ফজলে রাব্বী মিয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এল.জি.ই.ডি এর অর্থায়নে ধনারুহায় একটি দৃষ্টিন্দন সৃতিস্তম্ভ ও পাঠাগার নির্মিত হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ৪ডিসেম্বর উপজেলা প্রশাসন সাঘাটা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাঘাটার যৌথ আয়োজনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি স্তম্ভ প্রাঙ্গণে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ প্রদান দোয়া মাহফিল, স্মৃতি চারণ মূলক আলোচনা সভা ও মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হবে। রোস্তম কোম্পানির বীর মুক্তিযোদ্ধা সহ জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদদের স্বজন, শহীদ পরিবারের সদস্য বৃন্দ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও একাত্তরের চেতনায় বিশ^াসী মানুষ, এলাকাবাসী এবং নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের উপ¯ি’তি তে ধনারুহা স্মৃতি স্তম্ভ চত্বর মুক্তিযুদ্ধের মিলন মেলায় রুপ নিবে। আমরা সবাই ফিরে যাবো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে। এ দিনে আমরা সুখি সমৃদ্ধ চলমান উন্নয়নের ধারা রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়বো এ প্রত্যাশায় জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধ,ু বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌতম চন্দ্র মোদক

কোম্পানি উপ-অধিনায়ক (টু.আই.সি)

রোস্তম কোম্পানি -১১ নম্বর সেক্টর ও

সাবেক ডেপুটি ইউনিট কমান্ডার, গাইবান্ধা জেলা ইউনিট কমান্ড ,বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

মোবাইল নং-০১৭১৮-২২৯৬৭৮