প্রতিনিধি, সাঘাটা
তিস্তামুখ ঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত সড়কসহ রেল সেতু অথবা টানেল নির্মাণ এবং বোনারপাড়া থেকে তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ সংস্কার ও পুণঃরায় ট্রেন চালুর দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় ঘন্টাব্যাপি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
ফুলছড়ি উপজেলার ফুলছড়ি বাজারস্ত থানা মোড়ে অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী আঞ্চলিক গণ সংগঠনÑ “সাঘাটা-ফুলছড়ি উন্নয়ন সংগঠন” এর ডাকে এক মানববন্ধন ও পথসভা হয়েছে।
সংগঠনের সভাপতি হাসান মেহেদী বিদ্যুৎ- এর আহ্বানে ও সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই মানববন্ধন ও পথসভায় বক্তব্য রাখেন, সংগঠনের উপদেষ্ঠা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম রাজা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা সরদার, গজারিয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ শামছুল আলম সরকার, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির গাইবান্ধা জেলা শাখার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য মাছুদুর রহমান মাসুদ, বাংলাদেশ যুব মৈত্রি গাইবান্ধা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোঃ আজাদুল ইসলাম আজাদ, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার সরকার মৃণাল, গজারিয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য জিহাদুর রহমান মওলা প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন, ভরতখালী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মোঃ হাবিবুর রহমান। সভায় বক্তরা আগামী ২৯ আগস্ট পঞ্চগড় থেকে বোনারপাড়া পর্যন্ত চালু হতে যাওয়া ‘রামসাগর এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি তিস্তামুখঘাট পর্যন্ত চলাচলের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রেলমন্ত্রী কাছে জোর দাবি জানান।
আয়োজনকারী সংগঠনের সভাপতি হাসান মেহেদী বিদ্যুৎ বলেন, জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থি’তিতে প্রথম জাতীয় সংসদে একাধিকবার তিস্তামুখ ঘাট টু বাহাদুরাবাদ রুটে যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য কথা হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাপান সরকার এ লক্ষে সমস্ত জরিপ ও সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সেতু নির্মাণের লক্ষে জনগণের কাছ থেকে যথাযথ মূল্যে ভূমি অধিগ্রহণও করে। কিন্তু‘ ১৯৭৫’র ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। অথচ সরকার একটু আন্তরিক হলেই অপেক্ষাকৃত সল্প ব্যয়ে এবং সল্গ সময়ে এ পথে ৪-৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কসহ রেলসেতু বা ট্যানেল নির্মাণ করে বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মানুষের প্রাণের দাবি বা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার সাঘাটা-ফুলছড়ি তথা গাইবান্ধাবাসীকে বাঁচাতে পারে। রেলওয়ের পূরনো ঐতিহ্য উদ্ধারের পাশাপাশি খুলে যেতে পারে অত্রাঞ্চলের উন্নয়ন অর্থনীতির এক নতুন দুয়ার। সভায় বক্তরা বলেন, প্রায় একশ পঁচিশ বছর ধরে রেল ও নৌ-পথকে কেন্দ্র করে সাঘাট-ফুলছড়ি অঞ্চলের সভ্যতা বিকশিত হয়ে আসছিল। কিন্ত‘ বছরের পর বছর ধরে জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি ও নানা ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে অবহেলিত সাঘাটা-ফুলছিড়িবাসী দেশের উন্নয়ন বৈষম্যের চরম শিকারে পরিণত হয়েছে। অত্রাঞ্চলের মানুষের অর্থনীতির উন্নয়নে সর্বো”চ মাধ্যম ছিল রেলপথ ও নৌ-পথ। বর্তমানে আমরা যা প্রায় হারিয়েই ফেলেছি।
১৯০০ সালের আগেই পার্বতীপুর থেকে রংপুরÑকাউনিয়া ও আসামের ধুবরী পর্যন্ত একটি এবং তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত একটি মিটারগেজ রেলপথ চালু হয়। এরপর ১৯০০ মতান্তরে ১৯০১ সালে সান্তাহার-বোনারপাড়া এবং ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সালের মধ্যে বোনারপাড়া-কাউনিয়া রেলপথ চালু হয়। রেল চালুর সময় এর নাম ছিলÑ ‘এ বি আর’ বা আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে। সূচনালগ্ন থেকে ফুলছড়ির তিস্তামুখ ঘাট থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট এবং জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে সিরাজগঞ্জ ঘাট রুটে যাত্রী ও মালামাল পারাপার শুরু হয়। বেশি দিন আগের কথা নয়, বাংলাদের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রেল যোগাযোগের ‘প্রবেশ দ্বার’ হিসেবে খ্যাত ছিল ফুলছড়ির তিস্তামুখ ঘাট। উত্তরাঞ্চলের ০৮ জেলার মানুষ এ পথেই ঢাকাসহ রেলযোগে দেশের পূর্ব ও অন্যন্যা অঞ্চলে যেতো। ৮০’র দশকের শুরুতে মেরিন বিভাগের কার্যক্রম সংকুচিত করতে সিরাজগঞ্জ থেকে জগন্নাথগঞ্জ রুটে যাত্রী পারাপার বা ফেরি সার্ভিস বন্ধ করা হয়। ৯০’র দশকের মাঝামাঝি জাতীয় ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে নদীর নাব্যতা সংকটের অজুহাতে ১৯৯৭’র অক্টোবরে তিস্তামুখ ঘাটের পরিবর্তে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফুলছড়ির উত্তরের শেষ সীমায় বালাসী ঘাটে ¯’ানান্তরিত হয়। বালাসী ঘাট চালুর কিছুদিন পরই সিরাজগঞ্জ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু’ চালু হয়। এরপর এ পথে রেল যোগাযোগ অনেকটা কমিয়ে আনা হয়। এরপর ২০০৫ সালে নাব্যতা সংকটের অজুহাতে এ পথেও যাত্রী পারাপারের ফেরী এবং ২০১৫ সালে মালবাহি জাহাজ পরিবহন কার্যক্রম বন্ধ হয়। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষ রেলের সমস্ত যাত্রী ও মালবাহী জাহাজ বিক্রি করে দিয়েছে। এখন বোনারপাড়া থেকে তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত রেল সংস্কার ও নতুন রেলপথ চালুর পরিবর্তে রেলপাত বিক্রির চূড়ান্ত বন্দোবস্ত চলছে বলে জানা গেছে। এমন পরি¯স্থিতিতে সাঘাটা-ফুলছড়িবাসী অবিলম্বে বোনারপাড়া থেকে তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ সংস্কার করে পুনরায় ট্রেন চালুর জোর দাবি জানায়। দীর্ঘদিন ধরে বোনারপাড়া থেকে তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ চলাচলের অযোগ্য হয়ে আছে। জন প্রত্যাশা ছিল- একদিন এপথে রেলপথ সংস্কার ও পুণরায় ট্রেন চালু হবে। কিš‘ সম্প্রতি একাধিক জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভাষ্য থেকে জানা যায়, খুব শীঘ্রই এ রুটের সমস্ত রেলপাত সরিয়ে নেয়া হবে। অথচ নতুন করে রেলপথ স্থাপন বা সংস্কার করে জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ও স্বপ্ন ট্রেন চালুর কোন পরিকল্পনা আপাতত নেই বলে মনে হচ্ছে। অভাবী ও নদী ভাঙন কবলিত এ দুই রুট থেকে রেলপাত অপসারণের সাথে সাথেই দৃষ্টিকটুভাবে রেলওয়ের জায়গা চর দখলের মতো অপদখলের শিকার হবে। যার বহু নজির এলাকায় আছে। মাঝখান থেকে জনগণ হবে বঞ্চিত। একই সাথে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের স্বপ্ন ও বক্তব্যের সাথে হবে সাংঘর্ষিক। সবশেষে এলাকাবাসীর উদ্দেশে বলতে চাইÑ এই আন্দোলন সফল করতে ইস্পাত কঠিন নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ ঐক্য চাই, সাঘাটা-ফুলছড়িবাসীর। যেকোন মূল্যে রেল সংস্কার ও পুণঃরায় ট্রেন চালুর সরকারি সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন রেলপাত এলাকা থেকে কেউ নিয়ে যেতে দেবেন না। তা না হলে স্বপ্নের ট্রেন চালু এবং সেতু বা টানেল নির্মাণ অবাস্তব ও স্বপ্নই রয়ে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :