নির্বিচারে শিকার হচ্ছে অতিথিসহ পরিযায়ী পাখি নিধন


প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ২৭, ২০২৪, ১:৫৭ অপরাহ্ণ / ১১৫
নির্বিচারে শিকার হচ্ছে অতিথিসহ পরিযায়ী পাখি নিধন

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জলাভূমি সিলেটের হাকালুকি হাওর এবং মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত হাইল হাওর ও বাইক্কা বিলে অতিথি পাখির ওপর চলছে স্থানীয় শিকারিদের তাণ্ডব। তাদের বিষ মাখানো খাবার খেয়ে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা এসব পাখি। ফাঁদ পেতেও ধরা হচ্ছে এগুলো। এতে এসব পরিযায়ী পাখির আগমন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও থেমে নেই নির্বিচারে শিকার। এসব পাখি নানা দামে কৌশলে বিক্রি করছে শিকারিরা। সিলেট ও মৌলভীবাজারের কিছু খাবার হোটেল ও স্থানীয়রা এর ক্রেতা। কখনও কখনও রাজধানীতেও কিছু পাখি পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে প্রশাসন কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, শিকারিদের তাণ্ডবে ও খাদ্যের উৎস ছোট হয়ে আসায় অতিথি পাখির আগমন কমে গেছে।

শীতের আমেজ শুরু হলে শীতপ্রধান দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে এসব এলাকায় আসতে থাকে এবং হাওর মাতিয়ে রাখে।

আগে হাকালুকি হাওরে বহু প্রজাতির হাঁসের আগমন ঘটত। রাজহাঁস, হাড়গিলা, ধরলি, সারস, বেয়ারের ভুঁতি হাঁস, তুঁতি হাঁস এখন আর চোঁখে পড়ে না। নির্বিচারে নিধনের ফলে বহু প্রজাতির পাখি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর এখানে আসছে না। পাখিগুলো ৮০০-৯০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজনের হয়ে থাকে। দাম পড়ে ২৫০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিছু পাখি এর চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হয়। এ হাওরের অবস্থান মৌলভীবাজারের জুড়ী, বড়লেখা, কুলাউড়া, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, হাকালুকি হাওরকে ‘রামসার’ এলাকা হিসেবে ঘোষণার দাবি উঠলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭১ সালের রামসার কনভেনশন অনুসারে বিভিন্ন দেশের জলজ প্রতিবেশের গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন জলাশয় রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকে।

তিনি বলেন, পর্যটকের কারণেও হাওরের জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মানবসৃষ্ট বিরূপ পরিবেশ থেকে হাকালুকি হাওরকে বাঁচাতে হবে। হাকালুকির অন্যতম সৌন্দর্য শীতকালে সেখানে জড়ো হওয়া হাজার হাজার অতিথি পাখি। হাওরের বুকে নৌকায় বসে এসব পাখির আনাগোনা দেখতে সেখানে ভিড় জমান হাজারো পর্যটক। তবে পাখি দেখতে আসা দর্শনার্থীরা পাখির জন্য খাবারের বিভিন্ন উচ্ছিষ্ট ছুড়ে দেন পানিতে। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি এসব খাবার গ্রহণের কারণে পাখির স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। একই সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে প্রজনন ক্ষমতা। খাবারের উচ্ছিষ্ট ও প্লাস্টিকের প্যাকেটের কারণে হাওরের পরিবেশও দূষিত হচ্ছে।

আব্দুল করিম বলেন, অতিথি পাখির আবাস দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। অতিথি পাখির মূল খাদ্য ছোট মাছ ও চিংড়ি জাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এরা পানির ওপরে ভাসমান পোকামাকড়ও খায়। মানুষের ছুড়ে দেওয়া খাবার এবং সেসবের সঙ্গে থাকা প্যাকেটের খাবার খেয়ে পাখির ছোট পেট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পাখি বিশেষজ্ঞ ড. ইনাম আল হক বলেন, হাওরের জীববৈচিত্র্য হারিয়ে এখানে পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণীর প্রজননক্ষেত্র আর অবশিষ্ট নেই। হাকালুকি ছেড়ে গেছে অতিথি ও দেশি পাখির দল। বিপুল মানুষের উপস্থিতি ও নানা উপদ্রবের কারণে পরিবেশের দূষণে এ অবস্থা। হাওরের অধিকাংশ বিলে এবার পানি কমে গেছে। শিকারিদের তাণ্ডব ও খাদ্যের উৎস ছোট হয়ে আসায় অতিথি পাখির আগমনও কমে গেছে।

প্রাক্তন শিক্ষক, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আপ্তাব আলীর (৮৭) চোখেও এ দৃশ্য ধরা পড়েছে। হাওরের বৈচিত্র্যময় পরিবেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা ও জীবনযাপন।

তিনি বলেন, আগেও কিছু মানুষ জাল দিয়ে পাখি শিকার করেছে। তা ছিল একেবারেই কম। এখনকার মতো বিষটোপ দিয়ে কেউ হাজার হাজার পাখি হত্যা করত না।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার হাকালুকি হাওরের ৭৫ হাজার হেক্টর জমিকে পরিবেশ বিপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০৩ সাল থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর জলাভূমির জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জলজ উদ্ভিদ সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম তৈরি ও পাখি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা হয়। ছয় বছরে উপকূলীয় জলাভূমির জীববৈচিত্র্য প্রকল্পের মাধ্যমে যতটুকু অগ্রগতি ও সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তা আর ধরে রাখা যায়নি। গত ১৪ বছরে হাওরের জন্য কোনো ফলোআপ প্রকল্প না থাকায় ধারাবাহিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

হাইল হাওর ও বাইক্কা বিলে প্রতি বছরের মতো এবারের শীত মৌসুমে এই অঞ্চলে পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। হাইল হাওর এলাকার বাসিন্দা সফল মিয়া জানান, হাইল হাওরের পাশাপাশি বিলের এবং কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর, ইসলামপুর ও হাজীপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় শিকার করা পাখি বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিতেশ রঞ্জন দেব বলেন, অবাধ শিকারের কারণে পাখির আশ্রয়ের পরিসর সীমিত হয়ে আসছে। পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে এর প্রজনন ও আবাসস্থল। অতিথি পাখির আগমনের এ সময়টিতে শিকারিরা বেশি সক্রিয় থাকে।

হাওর-বিলের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা থেকে শিকার করা পাখি খুব গোপনে বিক্রি হয় জানিয়ে মৌলভীবাজার পরিবেশ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি সৈয়দ মহসীন পারভেজ বলেন, গ্রামের অনেক মানুষ এখনও জানে না যে পাখি শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ।

শ্রীমঙ্গল বাইক্কা বিল বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠনের সভাপতি পিয়ার আলী জানান, পাখির নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারিভাবে পাহারাদার বাড়ানো হলে পাখি শিকার কমে আসবে।

তবে প্রশাসনের তৎপরতা সীমিত বলে জানা গেছে। সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকা থেকে খাজা মিয়া নামে এক পাখি শিকারিকে বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি ও পাখি ধরার সরঞ্জামসহ আটক করা হয়। এ সময় তাঁকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া মৌলভীবাজারের থানা বাজার এলাকা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির আটটি পাখিসহ আটক আব্দুস শহীদকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাশাপাশি ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় তাঁকে।

অবশ্য বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, পাখি শিকার বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পাখি শিকারিদের বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বন বিভাগের নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সচেতনতা কার্যক্রমও চালিয়ে আসছেন তারা। তারপরও তেমন সুফল মিলছে না।