২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হবে ২৪-৩০ বিলিয়ন ডলার
বিদ্যুৎ, শিল্পসহ অন্যান্য খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমদানি করা হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কয়লা ও জ্বালানি তেল। এসব খাতে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান হারে দেশে জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। সরকারের জ্বালানি ব্যয়ের প্রাক্কলন ধরে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার।
এ অবস্থায় চলমান ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য হলো সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে বিপাকে পড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধানে জোর দেয়া হলে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। পাশাপাশি নিজস্ব কয়লা উত্তোলনেও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিয়ে গতকাল ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা উঠে আসে। সংগঠনটি তাদের মতিঝিলের কার্যালয়ে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ‘বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার: বঙ্গবন্ধুর দর্শন’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে। এতে ব্যবসায়ীরা দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে বেশকিছু আশঙ্কার চিত্র তুলে ধরেন। পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধান, কয়লা উত্তোলন করা গেলে ডলার সাশ্রয়ীর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এলএনজি আমদানিতে নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় জ্বালানি অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এখনো অনুসন্ধান কার্যক্রমের বাইরে আছে। বিশাল সমুদ্রের কোনো সম্পদই আমরা এখনো আহরণ করতে পারিনি। আমাদের এখন পর্যন্ত যত গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে, সবগুলোই খুব সহজে পাওয়া যায় এমন গ্যাসক্ষেত্র। যেসব গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে আমাদের অনেক বেশি শ্রম দিতে হবে, সেগুলোতে এখনো আমরা হাত দিইনি।’
অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘গ্যাস ছাড়াও আমাদের কয়লা, খনিজ বালি, লোহার খনিসহ অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, সেগুলোয়ও মনোনিবেশ করতে হবে।’
স্বাগত বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘চলমান বৈশ্বিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের জ্বালানি খাত। এটি দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। জ্বালানির দাম বাড়ায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় গ্যাস, কয়লা ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনে সরকারের জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’
সরকারের গ্যাসের চাহিদা ও জ্বালানি আমদানিসংক্রান্ত প্রাক্কলন তুলে ধরে এফবিসিসিআই জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে দৈনিক ৫ হাজার ৭৯ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বর্তমান চাহিদার চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। দেশে গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবে বর্তমানে চাহিদা পূরণে কেবল আমদানিনির্ভরতা থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু জ্বালানি আমদানিতেই ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বড় অংশই ব্যয় হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানিতে। এক প্রক্ষেপণে দেখা যায়, ২০২৭ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হবে গ্যাসভিত্তিক ১৬ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৬ হাজার ৪৯৭ মেগাওয়াট ও কয়লাভিত্তিক ৭ হাজার ৯১ মেগাওয়াট। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হবে ৫৯১ মেগাওয়াট। আমদানি করা হবে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা ও বিদ্যমান বাজার দর হিসাব করলে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় বাড়বে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ অতিরিক্ত ব্যয়ের ৬-৭ বিলিয়ন ডলার যাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য। এছাড়া কয়লায় ৫ বিলিয়ন এবং আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ, ফার্নেস অয়েল, নিউক্লিয়ার ফুয়েলের জন্য ব্যয় বাড়বে ৯ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ অনুযায়ী, দেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে সাড়ে পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। বিদ্যমান গ্যাসের সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি (এলএনজিসহ)। স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ একই পরিমাণ থাকলে দৈনিক আরো প্রায় আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হবে।
বিপুল পরিমাণ এ জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বরং বিকল্প হিসেবে কয়লা এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে তৎপর হতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশের যে লক্ষ্য, সেখানে আমদানিনির্ভর জ্বালানি ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে গেলে আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা থাকবে না। এসব আমদানিতে অনেক সময় ডলার সংকট হতে পারে, আবার টাকা দিয়েও অনেক সময় জিনিস পাওয়া যায় না। এজন্য আমরা মনে করি, আমাদের আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে শিল্পায়ন করতে হলে আমাদের কয়লা উত্তোলনের দিকে যেতে হবে। কিন্তু আমরা উত্তোলনের দিকে যাচ্ছি না কেন? আমদানি করে আমরা কি পারব? আমাদের ২০৪১ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগবে। এত বিদ্যুৎ আমদানীকৃত কয়লা বা গ্যাসের মাধ্যমে উৎপাদন করা সম্ভব কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। এজন্য দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধানে আরো বেশি জোর দিতে হবে। অফশোর বা অনশোরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’
স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানি করছে সরকার। এতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক ক্ষয় হচ্ছে। এ কয়লা স্থানীয়ভাবে উত্তোলন করা গেলে প্রচুর ডলার সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলে যেসব কয়লা খনির সন্ধান মিলেছে, সেগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে খনিসংলগ্ন এলাকার জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে সেখানে বৃহদায়তনে কয়লা উত্তোলনে যেতে হবে। এতে করে দেশের জ্বালানি সংকটের চাপ কিছুটা কমবে।’
অনুষ্ঠানে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সরকার স্থানীয় গ্যাসের অনুসন্ধানের পাশাপাশি আমদানির উৎস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আসন্ন নতুন জ্বালানি এবং এ খাতের আধুনিকায়নের কথা তুলে ধরেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘আগামী দুই বছর যদি আমরা ৫০টি কূপ ড্রিল করি তাহলে ৬০০-৬৫০ এমএমসিএফ গ্যাস পাব। কিন্তু ৬৫০ এমএমসিএফ গ্যাস কমেও যাবে। এটিও কিন্তু মাথায় রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন যে গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে, এ গ্যাস দিয়ে আর নয় বছর চলবে। যেভাবে আমরা ব্যবহার করছি, তাতে আরো কম সময়ে এটি ফুরিয়ে যেতে পারে। তাহলে আট বছর পর কী হবে? এ প্রশ্ন থেকে যায়। গ্যাসফিল্ড যা আবিষ্কার হচ্ছে, তাতে ১০-১৫ এমএমসিএফ গ্যাস যুক্ত হচ্ছে, এর বেশি নয়। ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, অনেকগুলো জায়গায় গ্যাস রয়েছে। একটা ড্রিল করতে খরচ হয় ৯ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার। ১০০ ড্রিল করতে গেলে দরকার ২ বিলিয়ন ডলার। ২০ শতাংশ পেলে পুরো টাকাই উঠে আসবে। ১০ শতাংশ পেলেও টাকা উঠে আসবে। যাচ্ছি না কেন? এর জন্য যে প্রস্তুতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, সেটিও আমাদের চিন্তা করে দেখতে হবে।’
সেমিনারে জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও পরিকল্পনা তুলে ধরেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব। এ সময় অন্যদের মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামির সাত্তার, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল আজিজ পাটোয়ারীসহ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।