Dhaka ০৪:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরের মাঠে সোনালী ধান, ঘরে তোলার স্বপ্ন বুনছেন চাষীরা

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৯:২৮:৩০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৩
  • ৯৯ Time View

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:

মৌলভীবাজার জেলায় গ্রাম-প্রান্তরে জুড়ে যত দূর চোখ যায়, চোখে পড়ে সোনালি ধান। পাকা ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন বুনছেন চাষীরা।

সময়টা এখন হেমন্তেরই, সোনালি ফসলের। নীল আকাশে মাঝেমধ্যে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ালেও বৃষ্টি নেই, সোনার ধানের গন্ধমাখা হাওয়া হেমন্তের প্রকৃতিতে বদলে দিয়েছে। প্যাঁচার ধূসর ডানার মতো একটু একটু করে কুয়াশার রঙে পালক খুলছে শীত। সকালে কুয়াশা আহ্লাদে জড়িয়ে থাকছে সবকিছু।

হেমন্তের এই একটা সময়ে মাঠের দিকে যতদূর তাকানো যায়, চোঁখে পড়ে সোনালি ধান শুয়ে আছে খেতে। মাঠ থেকে এখন চোখ ফেরানো যায় না। মাসটি এখন অগ্রহায়ণ। বাংলার ঘরে ঘরে এখন শস্য-উৎসবের সময়। সব শ্রম ও আনন্দ ঢেলে মাঠে মাঠে যে সোনার ধান চাষ করেছেন চাষি, সেই শিশু গাছগুলো তারুণ্য পেরিয়ে শস্যবতী। সেগুলোর শরীরভরা পরিপুষ্ট ধানের প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য আর মায়া। দুই-তিনটি মাস ধরে চাষিরা এই শস্যবতী গাছেরই পরিচর্যা করেছেন, ফসলের অপেক্ষা করেছেন। মুঠো মুঠো সোনা হয়ে এই ধান একদিন কিষান-কিষানির কাছে যাবে, দক্ষিণ ভিটের ঘরের গোলায় উঠবে। এখন এই ধান ঘরে তোলার মুহূর্ত। মাঠ সেই মুহূর্ত বুকে নিয়ে ডাকছে চাষিকে।

এই ডাক চাষিরাই বোঝেন, অন্য কারও কাছে এই ডাকের সাড়া নেই। তাঁরা তাই বসে নেই—তাঁরা তো এই ধান তুলতেই যাঁর যাঁর মতো প্রস্তুত হয়ে আছেন।

মৌলভীবাজারের মাঠগুলো এখন যে সোনালি রঙে অঘ্রানের তাজা রোদে হাসছে, এই হাসিই যুগ যুগ ধরে এই বাংলার গ্রামগুলোর প্রাণ হয়ে আছে। যখন খরা, বন্যা ও দুর্যোগে এই মাঠ সোনার মতো হয়ে উঠতে পারে না, মানুষ বড় বেদনায় কাঁদতে থাকে। মানুষ বড় একা হয়ে যায়। এখানে-সেখানে যতই ওলটপালট হোক, এ ফসলটুকুই যেন গ্রামগুলোতে প্রাণের ধুকপুককে সতেজ রাখে, বাঁচিয়ে রাখে। শান্তি ও স্বস্তির শ্বাস এটুকুতে যতটা নির্মল, অন্য কোথাও নেই।

এবার আমন ফসলে কোনো বিপর্যয় ছিল না। দস্যু পোকামাকড়ের হানা ছিল না। সঠিক সময়ে বৃষ্টি নেমেছে। এতে ফসলও ভালো হয়েছে। হাওর মূলত বোরো ধানেই উদার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি না, এবার প্রকৃতি অন্যরকম ছিল। বৃষ্টি কম হয়েছে। জেলার কাউয়াদীঘি হাওরে পানি কম হয়েছে। অন্য বছর হাওর যতটা ডুবে থাকে, প্রশস্ত থাকে, এবার ততটা ডুবেনি। পানি কম হওয়ায় হাওরের যেসব জমিতে বোরো ছাড়া আর কোনো ফসলের চাষ কল্পনাতেও ছিল না কারও জন্য, সেসব জমিতে এবার রোপা আমন ধানের চাষ হয়েছে। আবহাওয়া জলবায়ুর পরিবর্তন যে বিরাজ করছে তা স্পটতই বিরাজমান।

হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদও সে রকমই বললেন, এ বছর হাওরে পানি কম থাকায় অনেক নিচু জায়গায়ও আমন ধানের চাষ হয়েছে। যে জায়গাগুলোতে অতীতে কোনোদিন আমনের চাষ হয়নি। ফসলও খুব ভালো হয়েছে। এই ভালো ফলনের কারণে শুধু গ্রামের মাঠগুলোই না, কাউয়াদীঘি হাওরের বহু জায়গায় সোনালি ধান ঝলমল করছে।

একসময় অগ্রহায়ণের বিকেল ছিল এ রকমই, কেটে নেওয়া আঁটি আঁটি ধান কাঁধে নিয়ে দল বেঁধে বাড়ি ফিরেছেন কৃষক। ফিরেছেন বাড়ির কাছে তৈরি ধানখোলায়। তারপর গরু-মহিষ দিয়ে উঠানে ও খোলায় ধান মাড়াই দেওয়া হয়েছে। কুলায় হাওয়া তুলে ধান ঝাড়াই করা হয়েছে। বিশাল হাঁড়ি-কড়াইয়ে ধান সেদ্ধ হয়েছে। অগ্রহায়ণে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের হাঁকডাকে বাড়িগুলো উৎসবমুখর থেকেছে। পাকা ধানের গন্ধে বাতাস আদুরে হয়েছে, উল্লাসে নেচেছে। 

এই উল্লাসমুখরতা এখনো হারিয়ে যায়নি। তবে সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলে গেছে। মানুষনির্ভর চাষবাসের পদ্ধতি পাল্টে তাতে যুক্ত হয়েছে যন্ত্র। ধানকাটা, ধানমাড়াই অনেক জায়গায় যন্ত্রের কাছে চলে গেছে। গরু-মহিষ তাড়ানোর হাঁকের বদলে মাড়াই করার যন্ত্রের শব্দই কানে আসে এখন।

তা বদল যা–ই হয়েছে, মাঠ তার চেনা রূপ ধরে রেখেছে এখনো। এখানে-ওখানে চলছে পাকা ধান কাটা। কেউ তো কাঁধে ধানের আঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। ধান সেদ্ধ, ধান শুকানো, ধানের ঘ্রাণ—সবই সেই পুরোনোই আছে। কিষান-কিষানি সেই ধানের গন্ধ ও কুঁড়ামাখা শরীরে এখনো অঘ্রানের মুহূর্তগুলো পার করেন। এখনো…‘ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে/ সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে’ এই মাঠ, এই হাওর মুখরই আছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

হাওরের মাঠে সোনালী ধান, ঘরে তোলার স্বপ্ন বুনছেন চাষীরা

Update Time : ০৯:২৮:৩০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৩

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:

মৌলভীবাজার জেলায় গ্রাম-প্রান্তরে জুড়ে যত দূর চোখ যায়, চোখে পড়ে সোনালি ধান। পাকা ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন বুনছেন চাষীরা।

সময়টা এখন হেমন্তেরই, সোনালি ফসলের। নীল আকাশে মাঝেমধ্যে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ালেও বৃষ্টি নেই, সোনার ধানের গন্ধমাখা হাওয়া হেমন্তের প্রকৃতিতে বদলে দিয়েছে। প্যাঁচার ধূসর ডানার মতো একটু একটু করে কুয়াশার রঙে পালক খুলছে শীত। সকালে কুয়াশা আহ্লাদে জড়িয়ে থাকছে সবকিছু।

হেমন্তের এই একটা সময়ে মাঠের দিকে যতদূর তাকানো যায়, চোঁখে পড়ে সোনালি ধান শুয়ে আছে খেতে। মাঠ থেকে এখন চোখ ফেরানো যায় না। মাসটি এখন অগ্রহায়ণ। বাংলার ঘরে ঘরে এখন শস্য-উৎসবের সময়। সব শ্রম ও আনন্দ ঢেলে মাঠে মাঠে যে সোনার ধান চাষ করেছেন চাষি, সেই শিশু গাছগুলো তারুণ্য পেরিয়ে শস্যবতী। সেগুলোর শরীরভরা পরিপুষ্ট ধানের প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য আর মায়া। দুই-তিনটি মাস ধরে চাষিরা এই শস্যবতী গাছেরই পরিচর্যা করেছেন, ফসলের অপেক্ষা করেছেন। মুঠো মুঠো সোনা হয়ে এই ধান একদিন কিষান-কিষানির কাছে যাবে, দক্ষিণ ভিটের ঘরের গোলায় উঠবে। এখন এই ধান ঘরে তোলার মুহূর্ত। মাঠ সেই মুহূর্ত বুকে নিয়ে ডাকছে চাষিকে।

এই ডাক চাষিরাই বোঝেন, অন্য কারও কাছে এই ডাকের সাড়া নেই। তাঁরা তাই বসে নেই—তাঁরা তো এই ধান তুলতেই যাঁর যাঁর মতো প্রস্তুত হয়ে আছেন।

মৌলভীবাজারের মাঠগুলো এখন যে সোনালি রঙে অঘ্রানের তাজা রোদে হাসছে, এই হাসিই যুগ যুগ ধরে এই বাংলার গ্রামগুলোর প্রাণ হয়ে আছে। যখন খরা, বন্যা ও দুর্যোগে এই মাঠ সোনার মতো হয়ে উঠতে পারে না, মানুষ বড় বেদনায় কাঁদতে থাকে। মানুষ বড় একা হয়ে যায়। এখানে-সেখানে যতই ওলটপালট হোক, এ ফসলটুকুই যেন গ্রামগুলোতে প্রাণের ধুকপুককে সতেজ রাখে, বাঁচিয়ে রাখে। শান্তি ও স্বস্তির শ্বাস এটুকুতে যতটা নির্মল, অন্য কোথাও নেই।

এবার আমন ফসলে কোনো বিপর্যয় ছিল না। দস্যু পোকামাকড়ের হানা ছিল না। সঠিক সময়ে বৃষ্টি নেমেছে। এতে ফসলও ভালো হয়েছে। হাওর মূলত বোরো ধানেই উদার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি না, এবার প্রকৃতি অন্যরকম ছিল। বৃষ্টি কম হয়েছে। জেলার কাউয়াদীঘি হাওরে পানি কম হয়েছে। অন্য বছর হাওর যতটা ডুবে থাকে, প্রশস্ত থাকে, এবার ততটা ডুবেনি। পানি কম হওয়ায় হাওরের যেসব জমিতে বোরো ছাড়া আর কোনো ফসলের চাষ কল্পনাতেও ছিল না কারও জন্য, সেসব জমিতে এবার রোপা আমন ধানের চাষ হয়েছে। আবহাওয়া জলবায়ুর পরিবর্তন যে বিরাজ করছে তা স্পটতই বিরাজমান।

হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদও সে রকমই বললেন, এ বছর হাওরে পানি কম থাকায় অনেক নিচু জায়গায়ও আমন ধানের চাষ হয়েছে। যে জায়গাগুলোতে অতীতে কোনোদিন আমনের চাষ হয়নি। ফসলও খুব ভালো হয়েছে। এই ভালো ফলনের কারণে শুধু গ্রামের মাঠগুলোই না, কাউয়াদীঘি হাওরের বহু জায়গায় সোনালি ধান ঝলমল করছে।

একসময় অগ্রহায়ণের বিকেল ছিল এ রকমই, কেটে নেওয়া আঁটি আঁটি ধান কাঁধে নিয়ে দল বেঁধে বাড়ি ফিরেছেন কৃষক। ফিরেছেন বাড়ির কাছে তৈরি ধানখোলায়। তারপর গরু-মহিষ দিয়ে উঠানে ও খোলায় ধান মাড়াই দেওয়া হয়েছে। কুলায় হাওয়া তুলে ধান ঝাড়াই করা হয়েছে। বিশাল হাঁড়ি-কড়াইয়ে ধান সেদ্ধ হয়েছে। অগ্রহায়ণে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের হাঁকডাকে বাড়িগুলো উৎসবমুখর থেকেছে। পাকা ধানের গন্ধে বাতাস আদুরে হয়েছে, উল্লাসে নেচেছে। 

এই উল্লাসমুখরতা এখনো হারিয়ে যায়নি। তবে সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলে গেছে। মানুষনির্ভর চাষবাসের পদ্ধতি পাল্টে তাতে যুক্ত হয়েছে যন্ত্র। ধানকাটা, ধানমাড়াই অনেক জায়গায় যন্ত্রের কাছে চলে গেছে। গরু-মহিষ তাড়ানোর হাঁকের বদলে মাড়াই করার যন্ত্রের শব্দই কানে আসে এখন।

তা বদল যা–ই হয়েছে, মাঠ তার চেনা রূপ ধরে রেখেছে এখনো। এখানে-ওখানে চলছে পাকা ধান কাটা। কেউ তো কাঁধে ধানের আঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। ধান সেদ্ধ, ধান শুকানো, ধানের ঘ্রাণ—সবই সেই পুরোনোই আছে। কিষান-কিষানি সেই ধানের গন্ধ ও কুঁড়ামাখা শরীরে এখনো অঘ্রানের মুহূর্তগুলো পার করেন। এখনো…‘ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে/ সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে’ এই মাঠ, এই হাওর মুখরই আছে।