Dhaka ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনামঃ
রাণীনগরে শিশু ও বাকপ্রতিবন্ধী বাবার দ্বি-খন্ডিত মরদেহ উদ্ধার চরাঞ্চলের চাষীদের মাঝে কৃষি উপকরণ প্রদান বোনারপাড়া বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী ২৫ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের ভারতে যাবার প্রাক্কালে বিজিবি’র হাতে আটক দু নারী ও শিশু রাণীনগরে মাজার-ঈদগাঁর ৯০লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ২৭ নভেম্বর,২০২৪ খ্রি.।। ম্ঙ্গলবার পীরগঞ্জের আলমপুর ইউপি চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবীতে মানবন্ধন জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে মতবিমিয় সভা সাঘাটায় বিশ্ব টয়লেট ডে উদযাপন ঘোড়াঘাটে যৌথ বাহিনীর অভিযান অস্ত্রসহ যুবক আটক

জলবায়ু সম্মেলন || প্রত্যাশায় উপেক্ষিত উত্তরজনপদের মানুষজনের কথা

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৮:১৮:৪৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
  • ৯ Time View

আফতাব হোসেন, গাইবান্ধা
আজারবাইজানের বাকুতে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন, কোপ-২৯। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মানুষজন এই সম্মেলনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। তবে, চলমান জলবায়ু সম্মেলনে উত্তরজনপদের মানুষের জীবনযাত্রার, অবস্থা, অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি কোনদিকে যাচ্ছে এসব বিষয়াদি উপেক্ষিত বলে জানিয়েছেন জলবায়ু প্রভাব মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা মানুষজন।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর গ্রামের হামিদা বেগম। গ্রামের একজন সাধারণ নারী থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ৪৫ বছরের জীবনে হামিদা বেগম ২০ বার নদীভ্ঙানে বিভিন্ন শিকার হয়েছেন। এই সময়ে আবাদি কৃষি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে নানা চরের ঘুরে ফিরেই কোনোমতে বেঁচে আছেন। তিনি জানান, জলবায়ু সম্মেলন হয় এটি তার কাছে নতুন শব্দ। এখানে কী হয়, কী নিয়ে আলোচনা হয় তা তিনি জানেন না। তিনি জানান, এই ধরনের সম্মেলন হলে অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত এবং নারীদের জীবনের কথা তুলে ধরা উচিত।
কামারজানি ইউনিয়নের সাবিনা বেগম জানান, ১০ বছর বয়সে পিতা-মাতা আমাকে বিয়ে দেয়। চরাঞ্চলের সামাজিক রীতি অনুযায়ী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে জীবন চলার পথের কষ্ট আমি বুঝি। শুধুমাত্র দারিদ্রতার কারণে পিতা-মাতা আমাকে বিয়ে দেয়। কিন্তু আমি সেই ভুল করেনি। আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছি। তিনি বলেন নারীদের সমস্যাগুলো শুনতে চায় না। জলবায়ুর কারণে নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এই চরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, চরের মানুষজনের নানা দুর্ভোগ। বন্যা, খরা, যাতায়াত, কৃষিপণ্য পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা-এসব নানা দুর্ভোগ নিয়েই চলতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নানা ধরণের নতুন নতুন দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো মোকাবেলা করার সক্ষমতা ও জ্ঞানও নেই মানুষজনের। তিনি বলেন এনজিওতে চাকুরীর সুবাদে জলবায়ু সম্মেলন হয় বিষয়টি জানি। তবে সম্মেলন এর ফলতো চরের মানুষজন পায় না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার দিঘলকানি চরের নুর ইসলাম প্রামানিক বলেন, গত কয়েক বছর ধরে অধিক তাপমাত্রা ও গরমে কৃষি, গরু-ছাগল ও হাসমুরগির উৎপাদন কমে গেছে। এজন্য লোকসানে পড়তে হচ্ছে। সাঘাটা বাজারে পল্ট্রি ফার্ম মালিক মিজানুর রহমান তোতা জানান, গরমের সময় ইলেকট্রিসিটি অব থাকায় ৪হাজার বয়লার মুরগি মরে গেছে।
সাঘাটা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি নিপেদ চন্দ্র দাস জানান, নদী, বিল ঝিলে মাছ এখন বলতে গিলে শুণ্যের কাছে। কী কারণে মাছ মিলছে না এসব বিষয়ে সম্যক জ্ঞান তার নেই। তিনি জানান, এজন্য সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরের চাষী আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যা ও নদীভ্ঙানের মতিগতি বোঝা যায়। একারণে চাষীরা কৃষি চাষাবাদ করে বছরের পুরো সময় খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারছেন না। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষকেরা ক্ষতি হলেও সেই ক্ষতিপুরণ পাচ্ছেন না।
এই গ্রামের কুদ্দুস বিশ্বাস জানান, পত্রিকা থেকে জানতে পেরেছেন জলাবায়ু সম্মেলন এর কথা। তবে, বেশিরভাগ মানুষ জানেন না জলবায়ুতে কেন পরিবর্তন হচ্ছে এবং এর জন্য দায়ীকে। তিনি বলেন, জলবায়ুর ক্ষতির সাথে সম্পৃক্ত দেশগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পাওটানা গ্রামের তাজুল ইসলাম জানান, অধিক বৃষ্টি ও বার বার বন্যায় চাষীরা সোঁজা হয়ে দাড়াতে পারছেন না। জলবায়ুর কারণে এসব হচ্ছে বলে তিনি জানলেও প্রতিরোধ কোন কাজ হচ্ছে না বলে তিনি জানান।
বিশিষ্ট লেখক জহুরুল কাইয়ুম জানান, উত্তরজনপদের মানুষজনের জীবনযাত্রা নির্ভর করে প্রকৃতির উপর। অধিক বন্যা যেমন ক্ষতি করে আবার বন্যা না হলেও কৃষি ও যোগাযোগে সমস্যায় পড়তে হয়। তিনি বলেন প্রকৃতি রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন এবং এজন্যই জলবায়ু সম্মেলন। তবে, এধরণের সম্মেলন খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
উত্তরাঞ্চলভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস্ সালাম জানান, চলতি বছর গণউন্নয়ন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তিনজন প্রতিনিধিত্ব করছেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রতিনিধিত্ব করা হচ্ছে। তবে উত্তরজনপদের মানুষজনের কথা তুলে ধরা হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী সহায়তা মিলছেন না।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত জানান, জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন দায়ী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। এজন্য তিনি এই সম্মেলনকে আরো বেশি কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা উচিত বলে জানান।
চলমান জলবায়ু সম্মেলন বহুবিধ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মূলত: এবারের সম্মেলনে আলোচ্য সূচির শীর্ষে রয়েছে অর্থায়ন। এ নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ আরো বেশি। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ জন্য উন্নত বিশ্ব কী পরিমাণ অর্থায়ন করে তা দেখার জন্য নাগরিক সমাজ অপেক্ষায় থাকেন।
প্রসঙ্গত, চলতি বছর ১১-২২ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস,কোপ। এটি বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ।
এদিকে, জাতিসংঘের সদ্যই প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে এই শতাব্দির সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিগত ২০২৩ সালের মতো, ২০২৪ সালেও দেশে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রলয়ঙ্করী তা-ব। জীবাশ্ম জ্বালানির অব্যাহত ব্যবহারে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আবহাওয়ার তীব্রতা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে সংকটে ফেলেছে। দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে ফেলেনি, প্রাণহানিসহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সম্পদ ও অর্থনীতির।
দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষও এ বছর আবহাওয়ার বিপন্নতা দেখেছে। বছরের শুরুতে তীব্র শীতের পর, প্রচ- দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। দীর্ঘস্থায়ী এই দাবদাহের পর তিস্তা,ব্রহ্মপুত্র-যুমনা অঞ্চলের মানুষজন তিন দফা বন্যার মুখোমুখি হয়।
তথ্য অনুযায়ী পরিবেশ বিপর্যয় শুধু বাংলাদেশই নয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটেছে । জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত থাকার কারণেই এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। এর ফলস্বরূপ ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে এই শতাব্দীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে এ বছরের বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। ফলে অন্য আর ১০টি ইস্যুর সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বাকুতে উন্নত দেশগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন।
উল্লেখ্য যে, গত একযুগে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর ভ্ঙানে গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার ৬০ হাজার পরিবারের প্রায় ৩লখা মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অন্ততপক্ষে ২০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি। বিলনী হয়েছে ১৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আংশিক ও সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২শ কিলোমিটার কাচাপাকা সড়ক। দারিদ্রতার সুচকেও শীর্ষ দশ জেলার মধ্যে উল্লিখিত তিন জেলা শীর্ষে।
আজই শেষ হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী সহায়তার বিষয়টি প্রত্যাশা অনুযায়ী উঠে আসেনি। তারপরেও যতটুকু প্রাপ্তি তা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের জন্য ব্যয় করা হবে এমনটাই দাবী উত্তরাঞ্চলের মানুষজনের।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

রাণীনগরে শিশু ও বাকপ্রতিবন্ধী বাবার দ্বি-খন্ডিত মরদেহ উদ্ধার

জলবায়ু সম্মেলন || প্রত্যাশায় উপেক্ষিত উত্তরজনপদের মানুষজনের কথা

Update Time : ০৮:১৮:৪৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

আফতাব হোসেন, গাইবান্ধা
আজারবাইজানের বাকুতে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন, কোপ-২৯। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মানুষজন এই সম্মেলনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। তবে, চলমান জলবায়ু সম্মেলনে উত্তরজনপদের মানুষের জীবনযাত্রার, অবস্থা, অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি কোনদিকে যাচ্ছে এসব বিষয়াদি উপেক্ষিত বলে জানিয়েছেন জলবায়ু প্রভাব মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা মানুষজন।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর গ্রামের হামিদা বেগম। গ্রামের একজন সাধারণ নারী থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ৪৫ বছরের জীবনে হামিদা বেগম ২০ বার নদীভ্ঙানে বিভিন্ন শিকার হয়েছেন। এই সময়ে আবাদি কৃষি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে নানা চরের ঘুরে ফিরেই কোনোমতে বেঁচে আছেন। তিনি জানান, জলবায়ু সম্মেলন হয় এটি তার কাছে নতুন শব্দ। এখানে কী হয়, কী নিয়ে আলোচনা হয় তা তিনি জানেন না। তিনি জানান, এই ধরনের সম্মেলন হলে অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত এবং নারীদের জীবনের কথা তুলে ধরা উচিত।
কামারজানি ইউনিয়নের সাবিনা বেগম জানান, ১০ বছর বয়সে পিতা-মাতা আমাকে বিয়ে দেয়। চরাঞ্চলের সামাজিক রীতি অনুযায়ী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে জীবন চলার পথের কষ্ট আমি বুঝি। শুধুমাত্র দারিদ্রতার কারণে পিতা-মাতা আমাকে বিয়ে দেয়। কিন্তু আমি সেই ভুল করেনি। আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছি। তিনি বলেন নারীদের সমস্যাগুলো শুনতে চায় না। জলবায়ুর কারণে নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এই চরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, চরের মানুষজনের নানা দুর্ভোগ। বন্যা, খরা, যাতায়াত, কৃষিপণ্য পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা-এসব নানা দুর্ভোগ নিয়েই চলতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নানা ধরণের নতুন নতুন দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো মোকাবেলা করার সক্ষমতা ও জ্ঞানও নেই মানুষজনের। তিনি বলেন এনজিওতে চাকুরীর সুবাদে জলবায়ু সম্মেলন হয় বিষয়টি জানি। তবে সম্মেলন এর ফলতো চরের মানুষজন পায় না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার দিঘলকানি চরের নুর ইসলাম প্রামানিক বলেন, গত কয়েক বছর ধরে অধিক তাপমাত্রা ও গরমে কৃষি, গরু-ছাগল ও হাসমুরগির উৎপাদন কমে গেছে। এজন্য লোকসানে পড়তে হচ্ছে। সাঘাটা বাজারে পল্ট্রি ফার্ম মালিক মিজানুর রহমান তোতা জানান, গরমের সময় ইলেকট্রিসিটি অব থাকায় ৪হাজার বয়লার মুরগি মরে গেছে।
সাঘাটা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি নিপেদ চন্দ্র দাস জানান, নদী, বিল ঝিলে মাছ এখন বলতে গিলে শুণ্যের কাছে। কী কারণে মাছ মিলছে না এসব বিষয়ে সম্যক জ্ঞান তার নেই। তিনি জানান, এজন্য সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরের চাষী আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যা ও নদীভ্ঙানের মতিগতি বোঝা যায়। একারণে চাষীরা কৃষি চাষাবাদ করে বছরের পুরো সময় খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারছেন না। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষকেরা ক্ষতি হলেও সেই ক্ষতিপুরণ পাচ্ছেন না।
এই গ্রামের কুদ্দুস বিশ্বাস জানান, পত্রিকা থেকে জানতে পেরেছেন জলাবায়ু সম্মেলন এর কথা। তবে, বেশিরভাগ মানুষ জানেন না জলবায়ুতে কেন পরিবর্তন হচ্ছে এবং এর জন্য দায়ীকে। তিনি বলেন, জলবায়ুর ক্ষতির সাথে সম্পৃক্ত দেশগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পাওটানা গ্রামের তাজুল ইসলাম জানান, অধিক বৃষ্টি ও বার বার বন্যায় চাষীরা সোঁজা হয়ে দাড়াতে পারছেন না। জলবায়ুর কারণে এসব হচ্ছে বলে তিনি জানলেও প্রতিরোধ কোন কাজ হচ্ছে না বলে তিনি জানান।
বিশিষ্ট লেখক জহুরুল কাইয়ুম জানান, উত্তরজনপদের মানুষজনের জীবনযাত্রা নির্ভর করে প্রকৃতির উপর। অধিক বন্যা যেমন ক্ষতি করে আবার বন্যা না হলেও কৃষি ও যোগাযোগে সমস্যায় পড়তে হয়। তিনি বলেন প্রকৃতি রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন এবং এজন্যই জলবায়ু সম্মেলন। তবে, এধরণের সম্মেলন খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
উত্তরাঞ্চলভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস্ সালাম জানান, চলতি বছর গণউন্নয়ন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তিনজন প্রতিনিধিত্ব করছেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রতিনিধিত্ব করা হচ্ছে। তবে উত্তরজনপদের মানুষজনের কথা তুলে ধরা হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী সহায়তা মিলছেন না।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত জানান, জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন দায়ী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। এজন্য তিনি এই সম্মেলনকে আরো বেশি কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা উচিত বলে জানান।
চলমান জলবায়ু সম্মেলন বহুবিধ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মূলত: এবারের সম্মেলনে আলোচ্য সূচির শীর্ষে রয়েছে অর্থায়ন। এ নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ আরো বেশি। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ জন্য উন্নত বিশ্ব কী পরিমাণ অর্থায়ন করে তা দেখার জন্য নাগরিক সমাজ অপেক্ষায় থাকেন।
প্রসঙ্গত, চলতি বছর ১১-২২ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস,কোপ। এটি বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ।
এদিকে, জাতিসংঘের সদ্যই প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে এই শতাব্দির সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিগত ২০২৩ সালের মতো, ২০২৪ সালেও দেশে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রলয়ঙ্করী তা-ব। জীবাশ্ম জ্বালানির অব্যাহত ব্যবহারে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আবহাওয়ার তীব্রতা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে সংকটে ফেলেছে। দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে ফেলেনি, প্রাণহানিসহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সম্পদ ও অর্থনীতির।
দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষও এ বছর আবহাওয়ার বিপন্নতা দেখেছে। বছরের শুরুতে তীব্র শীতের পর, প্রচ- দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। দীর্ঘস্থায়ী এই দাবদাহের পর তিস্তা,ব্রহ্মপুত্র-যুমনা অঞ্চলের মানুষজন তিন দফা বন্যার মুখোমুখি হয়।
তথ্য অনুযায়ী পরিবেশ বিপর্যয় শুধু বাংলাদেশই নয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটেছে । জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত থাকার কারণেই এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। এর ফলস্বরূপ ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে এই শতাব্দীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে এ বছরের বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। ফলে অন্য আর ১০টি ইস্যুর সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বাকুতে উন্নত দেশগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন।
উল্লেখ্য যে, গত একযুগে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর ভ্ঙানে গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার ৬০ হাজার পরিবারের প্রায় ৩লখা মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অন্ততপক্ষে ২০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি। বিলনী হয়েছে ১৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আংশিক ও সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২শ কিলোমিটার কাচাপাকা সড়ক। দারিদ্রতার সুচকেও শীর্ষ দশ জেলার মধ্যে উল্লিখিত তিন জেলা শীর্ষে।
আজই শেষ হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী সহায়তার বিষয়টি প্রত্যাশা অনুযায়ী উঠে আসেনি। তারপরেও যতটুকু প্রাপ্তি তা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের জন্য ব্যয় করা হবে এমনটাই দাবী উত্তরাঞ্চলের মানুষজনের।