
সুদীপ্ত শামীম:
জীবনের পথ কখনো মসৃণ হয় না। প্রত্যেকটি মুহূর্ত আমাদেরকে এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে, আর সেই চ্যালেঞ্জগুলি আমাদের অভিজ্ঞতা, চিন্তা এবং মনোভাবকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যায়। আমরা কত কিছুই না ছেড়ে আসি—প্রিয় মানুষ, প্রিয় জায়গা, চাওয়া-পাওয়া, এমনকি কখনো নিজেকে। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চয়ই জানি, যা কিছু আমরা ফেলে আসি, তা কখনো ফিরে আসে না। অতীতের স্মৃতির গহ্বরে ডুব দিয়ে সেগুলির প্রতি আনুগত্য দেখানো আর আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে সহায়ক নয়। আসলে এটি আমাদের চলার পথে অযথা ভার হয়ে দাঁড়ায়।
জীবনে যখন বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যখন আমরা নতুন পথ বেছে নিই, তখন এক অদৃশ্য টান অনুভব করি—পুরনো এক জায়গা, পুরনো এক চিন্তা, পুরনো সম্পর্ক। এইসবের প্রতি আমাদের মনোভাব কখনো কখনো শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, যেন সেগুলির সাথে সম্পর্কিত যে কোনো অনুভূতি বা স্মৃতি আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে, এক সময় আসেই, যখন আমরা বুঝতে পারি, অতীতের সঙ্গে আঁটকে থাকলে আমরা কখনোই সামনে এগোতে পারব না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নেই, ‘তারপর আমি যা ফেলে আসি, সেদিকে আর ফিরেও তাকাই না।’
এই সিদ্ধান্তটি শুধুমাত্র একটি চিন্তা নয়, এটি একটি গভীর আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ। যখন আমরা অতীতের শোক, আফসোস এবং খেদ নিয়ে বসে থাকি, তখন আমরা নিজের বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে অবহেলা করি। জীবনের এই অন্তহীন চলাচলে একটানা পেছন ফিরে তাকানো আমাদেরকে এক জায়গায় স্থির করে ফেলতে পারে এবং এই স্থিরতা কখনোই আমাদের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যায় না। যদি আমরা অতীতের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকি, তাহলে আমরা বর্তমানের মূল্যবান মুহূর্তগুলো মিস করি, এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে পারি না। কিন্তু কেন মানুষ অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকে? কেন আমরা অনেক সময় অতীতের প্রতি এত বেশি মনোযোগী হয়ে উঠি? কারণ, মানুষের স্বভাবই এমন—ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, হতাশা এবং অজানা ভবিষ্যতের প্রতি অনিশ্চয়তা। আমরা অনেক সময় অতীতের ভাললাগা কিংবা ব্যথা-যন্ত্রণা মেনে নিয়ে থাকি, কারণ সেটি আমাদের পরিচিত। কিন্তু এই পরিচিতি কখনোই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে না। জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে হলে, পুরনো অভ্যস্ততা ও চিন্তা-ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
তবে এই সিদ্ধান্তের মাঝে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল অতীতের যন্ত্রণাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া। যদি তুমি অতীতের প্রতি পিছুটান দিয়ে চলতে থাকো, তাহলে তুমি একসময় অনুভব করবে, তুমি সেই অবস্থায় আটকে পড়েছো। যখন তুমি পেছন ফিরে তাকাবে, তখন তুমিই একমাত্র শিকার। যখন তুমি এক পা সামনে এগিয়ে যাবে, তখন তুমি পাবে এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আলো, নতুন সব কিছু। অতীতের শোক, কষ্ট এবং হতাশা শুধুমাত্র তোমাকে টেনে নিয়ে যাবে—আরো পিছিয়ে দেবে। আর তোমার সামনে যেটি রয়েছে, তা হলো নতুন জীবন, নতুন সুযোগ এবং নতুন অভিযানের অভিজ্ঞতা। এটি সত্যি যে, অতীতের স্মৃতির কিছুটা শোক থাকে। কিছু মুহূর্ত, কিছু সম্পর্ক, কিছু সিদ্ধান্ত যা আমাদের ভালোবাসার ছিল, তা আমাদের কখনোই পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারি না। কিন্তু জীবন এগিয়ে চলা এবং সেখানেই নতুন অধ্যায় তৈরি করা। তুমি যখন অতীতের আঁচল ধরে চলতে থাকবে, তখন তোমার হাত থেকে একে একে নতুন আনন্দ, নতুন সাফল্য এবং নতুন সম্ভাবনা চলে যাবে। আসলে যখন তুমি অতীতের দিকে তাকানোর বদলে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করবে। তখন তুমি অনুভব করবে, জীবনের প্রকৃত আনন্দ কোথায়।
কখনো কখনো জীবনের সবচেয়ে বড় সাহসিকতা হলো পুরনো সম্পর্ক, পুরনো ভুল, পুরনো যন্ত্রণা—সবকিছু মেনে নিয়ে এগিয়ে চলা। সত্যিকারভাবে জীবনের সাফল্য তখনই আসে, যখন তুমি বুঝতে পারো—পুরনো কিছু আর তোমার জীবনে আর কোনো স্থান নেই। তুমি যদি পুরনো অভ্যাস, পুরনো চিন্তা, কিংবা অতীতের কোনো স্মৃতির অজুহাতে এক স্থানে থেমে যাও, তবে তুমি কখনোই সামনে এগোতে পারবে না। পৃথিবী তার গতিতে চলতে থাকে, জীবনও সেভাবেই এগিয়ে চলে এবং আমরা যদি এক জায়গায় থেমে যাই, তবে আমরা সেই গতির অংশ হতে পারি না। অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং এগিয়ে যাওয়া—এটাই আসল জীবন। যে কোনো কিছু যদি আমাদের ভাগ্যকে বদলাতে না পারে, তবে সেটিকে বয়ে নিয়ে চলা অর্থহীন। অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, যে জীবন আমরা নতুন করে গড়তে পারি, সেটি শুধু আমাদেরই অপেক্ষা করছে। তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। যা কিছু আমরা ফেলে আসি, তা আর ফিরে পাব না—তাহলে, কেন সে দিকে তাকানো? শুধু সামনে এগিয়ে যেতে হবে, কারণ ভবিষ্যতের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে।
তারপর আমি যা ফেলে আসি, সেদিকে আর ফিরেও তাকাই না—এটি একটি প্রতিজ্ঞা, একটি সংকল্প, একটি পথচলা যা আমাদের আগামীকে আলোকিত করে।
-সুদীপ্ত শামীম
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক।
ইমেইল: news.shamimsarker@gmail.com
০১৭১৭-০৫২৬৮৩।