Dhaka ০৩:৪৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘অমরত্বকে তাচ্ছিল্য’ করা সরোজ দেব

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৯:২৮:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ১৮ Time View

 

রজতকান্তি বর্মনঃ কবিরা হলেন সত্য, সুন্দরের উপাসক। কিন্তু সমাজ থেকে সত্য, সুন্দর নির্বাসিত হতে শুরু করেছে। সমাজের বর্তমান অবস্থা সহ্য করতে পারবেন না বলে কবি সরোজ দেব বিছানায় শুয়ে নিদারুণ রোগ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর প্রস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। নিজ বাড়িতে তিনি সরকারি, ব্যক্তিগত সহায়তায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। শেষের দিকে তাঁর সহায়তা পাওয়াও কমে গিয়েছিল। মানুষ আর কতো সাহায্য দিবে! আসলে তিনি মৃত্যুকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছেন। আমরা দেখেছি, সকালে একটা পরোটা বা বিস্কুট আর কাপের পর কাপ চা খেয়ে সারাদিন কাজ করেছেন। খালি পেটে, অর্ধপেটে থেকে শরীরের ওপর তিনি যুক্তিহীন নিপীড়ন করেছেন দিনের পর দিন।
‘মৃত্যুর কাছে হাঁটু গেড়ে
যে মানুষ মৃত্যু ভিক্ষা চায়
তার মতো কে আর
দুঃখী আছে বলো?’
না, তার মতো কেউ আর দুঃখী নেই। দুঃখ থেকে নিষ্কৃতি পেতে সরোজ দেব মৃত্যুর কাছে হাঁটু গেড়ে মৃত্যু ভিক্ষা চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে করুণা করেনি। অবশেষে তিনি দীর্ঘ মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুর কাছে লীন হয়ে গেলেন, মৃত্যু তাঁর আকুতি-হাহাকার শুনলো। আমি মনে করি, বৈষয়িক ভেদবুদ্ধিহীন মানুষের কাছে মৃত্যু একধরনের উজ্জ্বল উদ্ধার। কবি সরোজ দেবও উদ্ধার লাভ করলেন। তাঁকে আর মানুষের কাছে হাত পাততে হবে না। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের কথা, পরিবার পরিজনের কথা না ভেবে মানুষের জন্য ভেবেছেন। নাওয়া খাওয়া ভুলে মানুষকে বিনোদন দিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, মানুষের জন্য শিল্প-সাহিত্য করেছেন। এসব করতে গিয়ে সমাজের কেউ কেউ তাঁকে বাঁকা চোখে দেখেছেন, অবহেলা করেছেন। না, সবাই তাঁকে ভালোবাসবে, সম্মান করবে- সেটাও বলছি না। কিন্তু তিনি তো মানুষের অমঙ্গল কিছু করেননি, অকল্যাণ কিছু চিন্তা করেননি! তারপরও কিছু মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটিয়েছে।
কবি সরোজ দেবের পার্থিব দেহ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাঁকে আর কেউ কোনো দিনই দেখতে পাবেন না। একথাও সত্য যে সরোজ দেব হয়তো ব্যক্তিগত সাংসারিক জীবনে ব্যর্থ ছিলেন। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে তিনি সফল মানুষ ছিলেন। নিজের প্রতি যত্নবান হলে জীবনটা তাঁর অনেক উন্নত হতো।
একটু পেছনের কথা বলি। ১৯৮৫ সালের কথা। গাইবান্ধা সরকারি কলেজে প্রথমবর্ষের ছাত্র। খারাপ ছাত্র ছিলাম না, তার ওপর আবার সাহিত্যের একটুআধটু খোঁজখবর রাখি বলে খুব অহংকার। কলেজ করি আর নিউমার্কেটে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। সেই আড্ডা যেমনতেমন আড্ডা নয়, হুলস্থুল আড্ডা। আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েরা যখন প্রেম নিয়ে মশগুল, আমরা তখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে সাহিত্যের রাজাউজির মারছি। একদিন নিউমার্কেটে শীর্ণ চেহারার এক ব্যক্তি ডাক দিলেন, এই তোর নাম রজত না! সরাসরি ‘তুই’ বলায় আমি চমকে যাই, অভিভূত হয়ে যাই, আরে একজন মানুষ আমাকে এতো আপন ভাবেন! সেই থেকে সরোজদা-কবি সরোজ দেব আমাকে তুই বলেন। ‘তুই’ বলার মধ্যে কী যে আত্মিক সম্পর্ক! সরোজদা কখনো তুই বলে সম্বোধন না করলে আমার মনটাই খারাপ হয়ে যেতো, ভাবতাম তিনি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। মানুষকে খুব সহজেই ভালোবাসার ক্ষমতার সকলের থাকে না। কিন্তু সরোজদা মানুষকে সহজেই কাছে টেনে নিতেন, আপন করে নিতেন। আমার মতো অনেককেই তুই বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর এই তুই বলার মধ্যে অন্যরকম একটা আবেগ জড়িত, স্নেহ জড়িত ছিল।
কবি সরোজ দেবের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৬ মার্চ গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাড়ায়। তিনি বিভিন্ন নামে শতাধিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, প্রাণেশ্বরীর মাচান, স্বজন শব্দাবলী, শতাব্দী, সংসপ্তক, মোহনা, নান্দনিক, বজ্রে বাজে বেণু, লাল গোলাপের জন্য ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘শব্দ’ ৫৬ বছর ধরে বের হয়েছে। শব্দে প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি অতি নবীনদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি শুধু নতুন লেখকই সৃষ্টি করেননি, তাদের লালনও করেছেন। গাইবান্ধার স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সূর্যকণা’ তার হাতেই গড়ে ওঠে। এই সংগঠনটি এক সময় সারাদেশে সংগীত জগতে আলোড়ন তুলেছিল। এই সংগঠনের শতশত সংগীত শিল্পী আজ সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন। সরোজ দেব ১৯৬৯ সালে গাইবান্ধা কলেজ ছাত্র সংসদের ম্যাগাজিন সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সরোজ দেব দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। বিজয়ী হয়ে ফিরে এসে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়নরত অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায় বলতে হয়, কবিতার জন্যই সরোজ দেব ‘অমরত্বকে তাচ্ছিল্য’ করেছেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

kartick kartick

Popular Post

‘অমরত্বকে তাচ্ছিল্য’ করা সরোজ দেব

Update Time : ০৯:২৮:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

 

রজতকান্তি বর্মনঃ কবিরা হলেন সত্য, সুন্দরের উপাসক। কিন্তু সমাজ থেকে সত্য, সুন্দর নির্বাসিত হতে শুরু করেছে। সমাজের বর্তমান অবস্থা সহ্য করতে পারবেন না বলে কবি সরোজ দেব বিছানায় শুয়ে নিদারুণ রোগ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর প্রস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। নিজ বাড়িতে তিনি সরকারি, ব্যক্তিগত সহায়তায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। শেষের দিকে তাঁর সহায়তা পাওয়াও কমে গিয়েছিল। মানুষ আর কতো সাহায্য দিবে! আসলে তিনি মৃত্যুকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছেন। আমরা দেখেছি, সকালে একটা পরোটা বা বিস্কুট আর কাপের পর কাপ চা খেয়ে সারাদিন কাজ করেছেন। খালি পেটে, অর্ধপেটে থেকে শরীরের ওপর তিনি যুক্তিহীন নিপীড়ন করেছেন দিনের পর দিন।
‘মৃত্যুর কাছে হাঁটু গেড়ে
যে মানুষ মৃত্যু ভিক্ষা চায়
তার মতো কে আর
দুঃখী আছে বলো?’
না, তার মতো কেউ আর দুঃখী নেই। দুঃখ থেকে নিষ্কৃতি পেতে সরোজ দেব মৃত্যুর কাছে হাঁটু গেড়ে মৃত্যু ভিক্ষা চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে করুণা করেনি। অবশেষে তিনি দীর্ঘ মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুর কাছে লীন হয়ে গেলেন, মৃত্যু তাঁর আকুতি-হাহাকার শুনলো। আমি মনে করি, বৈষয়িক ভেদবুদ্ধিহীন মানুষের কাছে মৃত্যু একধরনের উজ্জ্বল উদ্ধার। কবি সরোজ দেবও উদ্ধার লাভ করলেন। তাঁকে আর মানুষের কাছে হাত পাততে হবে না। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের কথা, পরিবার পরিজনের কথা না ভেবে মানুষের জন্য ভেবেছেন। নাওয়া খাওয়া ভুলে মানুষকে বিনোদন দিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, মানুষের জন্য শিল্প-সাহিত্য করেছেন। এসব করতে গিয়ে সমাজের কেউ কেউ তাঁকে বাঁকা চোখে দেখেছেন, অবহেলা করেছেন। না, সবাই তাঁকে ভালোবাসবে, সম্মান করবে- সেটাও বলছি না। কিন্তু তিনি তো মানুষের অমঙ্গল কিছু করেননি, অকল্যাণ কিছু চিন্তা করেননি! তারপরও কিছু মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটিয়েছে।
কবি সরোজ দেবের পার্থিব দেহ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাঁকে আর কেউ কোনো দিনই দেখতে পাবেন না। একথাও সত্য যে সরোজ দেব হয়তো ব্যক্তিগত সাংসারিক জীবনে ব্যর্থ ছিলেন। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে তিনি সফল মানুষ ছিলেন। নিজের প্রতি যত্নবান হলে জীবনটা তাঁর অনেক উন্নত হতো।
একটু পেছনের কথা বলি। ১৯৮৫ সালের কথা। গাইবান্ধা সরকারি কলেজে প্রথমবর্ষের ছাত্র। খারাপ ছাত্র ছিলাম না, তার ওপর আবার সাহিত্যের একটুআধটু খোঁজখবর রাখি বলে খুব অহংকার। কলেজ করি আর নিউমার্কেটে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। সেই আড্ডা যেমনতেমন আড্ডা নয়, হুলস্থুল আড্ডা। আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েরা যখন প্রেম নিয়ে মশগুল, আমরা তখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে সাহিত্যের রাজাউজির মারছি। একদিন নিউমার্কেটে শীর্ণ চেহারার এক ব্যক্তি ডাক দিলেন, এই তোর নাম রজত না! সরাসরি ‘তুই’ বলায় আমি চমকে যাই, অভিভূত হয়ে যাই, আরে একজন মানুষ আমাকে এতো আপন ভাবেন! সেই থেকে সরোজদা-কবি সরোজ দেব আমাকে তুই বলেন। ‘তুই’ বলার মধ্যে কী যে আত্মিক সম্পর্ক! সরোজদা কখনো তুই বলে সম্বোধন না করলে আমার মনটাই খারাপ হয়ে যেতো, ভাবতাম তিনি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। মানুষকে খুব সহজেই ভালোবাসার ক্ষমতার সকলের থাকে না। কিন্তু সরোজদা মানুষকে সহজেই কাছে টেনে নিতেন, আপন করে নিতেন। আমার মতো অনেককেই তুই বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর এই তুই বলার মধ্যে অন্যরকম একটা আবেগ জড়িত, স্নেহ জড়িত ছিল।
কবি সরোজ দেবের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৬ মার্চ গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাড়ায়। তিনি বিভিন্ন নামে শতাধিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, প্রাণেশ্বরীর মাচান, স্বজন শব্দাবলী, শতাব্দী, সংসপ্তক, মোহনা, নান্দনিক, বজ্রে বাজে বেণু, লাল গোলাপের জন্য ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘শব্দ’ ৫৬ বছর ধরে বের হয়েছে। শব্দে প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি অতি নবীনদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি শুধু নতুন লেখকই সৃষ্টি করেননি, তাদের লালনও করেছেন। গাইবান্ধার স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সূর্যকণা’ তার হাতেই গড়ে ওঠে। এই সংগঠনটি এক সময় সারাদেশে সংগীত জগতে আলোড়ন তুলেছিল। এই সংগঠনের শতশত সংগীত শিল্পী আজ সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন। সরোজ দেব ১৯৬৯ সালে গাইবান্ধা কলেজ ছাত্র সংসদের ম্যাগাজিন সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সরোজ দেব দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। বিজয়ী হয়ে ফিরে এসে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়নরত অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায় বলতে হয়, কবিতার জন্যই সরোজ দেব ‘অমরত্বকে তাচ্ছিল্য’ করেছেন।